স্টাফ রির্পোটার: সিলেট সদর উপজেলার টুকেরবাজারের মালনীছড়া ও আলীবাহার চা বাগান এলাকায় কাটা হচ্ছে ছয়টি টিলা। কখনও দিনে বা কখনও রাতে এসব টিলার মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ‘লন্ডনি টিলা’র বেশির ভাগ এরই মধ্যে কাটা হয়ে গেছে। সেখানে হচ্ছে ‘জাহাঙ্গীরনগর আবাসিক এলাকা’। শুধু ‘লন্ডনি টিলা’ নয়, আইন অমান্য করে গত দুই যুগে কেটে ফেলা হয়েছে সিলেটের বহু টিলা। নগরীর আশপাশ এখন অনেকটা টিলাশূন্য। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রভাবশালী একটি চক্র এসব টিলা কাটায় জড়িত। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। নগরীর বালুচর, করের পাড়া, আখালিয়া, ব্রাহ্মণশাসন, গ্রিনসিটি, দুসকি, জাহাঙ্গীরনগর, বড়গুল, গুচ্ছগ্রাম, বাহুবল, বহর কলোনি, আলবারাকা, মেজরটিলা, ফাল্গুনী ও জোনাকী এলাকায় টিলা কেটে গড়ে তোলা হয়েছে বা হচ্ছে আবাসিক এলাকা। হাওলাদারপাড়ার মজুমদার টিলার চারপাশে এখন উচুঁ ভবন, সেখানে হয়েছে ‘শান্তিনিকেতন আবাসিক এলাকা’। বাহুবল আবাসিক এলাকায়ও পাহাড় কেটে মাটি সরানো হচ্ছে। খাদিমনগর বহর কলোনির পশ্চিমে খাদিম চা বাগানের টিলা কেটে ভরাট করা হচ্ছে পাশের একটি পুকুর। স্থানীয়রা জানান, মালনীছড়া ও আলীবাহার চা বাগানের মধ্যবর্তী এলাকার টিলা কাটছেন দিলওয়ার খান নামে এক লন্ডন প্রবাসী, সঙ্গে আছেন আরও কয়েকজন। লন্ডনি টিলায় ‘জাহাঙ্গীরনগর আবাসিক এলাকা’ প্রকল্পটি তাঁরই। ছেলে জাহাঙ্গীর খানের নামে তিনি হাউজিং প্রকল্পটি করেছেন। তবে দিলওয়ার খানের দাবি, তিনি টিলা কাটছেন না, শুধু সড়ক সংস্কার করছেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে যাতে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য টিলায় কিছু কাজ করানো হচ্ছে।’ অভিযোগ রয়েছে, খাদিম এলাকায় টিলা কাটছেন মখলিছুর রহমান, রতন মুহুরি, আবুল কালাম আজাদ পাটোয়ারী ও সিরাজ মিয়া। তারাই টিলা কাটার সব ব্যবস্থা করছেন। তাদের সহযোগী হিসেবে আছেন হাতিম আলী গাজী, গিয়াস উদ্দিন, জসীম উদ্দিন, মামুন চৌধুরী, আরাফাত হোসেন তারেক, বাদশা মিয়া, রফিক মিয়া, হুমায়ুন আহমেদ মানিক মিয়া, সাদিকুর রহমান, আক্কাস আলী, রফিক দেওয়ান, সাইফুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া এখানে চা বাগানের টিলা কেটে ও পাশের খাস জমি দখল করে গড়ে উঠেছে ‘সিরাজনগর’ ও ‘সবুজনগর’ আবাসিক এলাকা। সিরাজ ও সবুজ হলেন বাবা-ছেলে। অবৈধভাবে টিলা কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে সিরাজ মিয়া বলেন,‘গোলাপগঞ্জের এক জমিদারের কাছ থেকে এসব জমি কিনেছি। তবে এগুলো নিয়ে মামলা চলছে।’ স্ট্যাম্পের মাধ্যমে চা বাগানের টিলার জমি বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘লোকজনের কাছে জমি বিক্রি করতে গেলে একটা কাগজ তো দিতে হয়।’ সিলেট নগরীর বালুচর এলাকা এক সময় পুরোটাই ছিল টিলা। অর্ধেকের বেশি টিলা কেটে সেখানে বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলো বাড়িও বানিয়েছেন কেউ কেউ। উরাং সম্প্রদায়ের চন্দন টিলা কাটা হচ্ছে রাতের আঁধারে। এই টিলার বাসিন্দা মিলন উরাং বলেন, ‘আমাদের টিলার ওপর ভূমিখেকোদের চোখ পড়েছে। ১২টি পরিবার আতঙ্কে আছি। মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, এখানে টিলা কাটছেন আবুল বসর। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘ওই এলাকায় আমার কয়েক একর জমি আছে।’ সিলেটে কাটা পড়া টিলাগুলোকে ব্যক্তিমালিকানার বলে উল্লেখ করেন কেউ কেউ। তবে দেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত টিলা কাটাও নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬ (খ) ধারা অনুযায়ী, সব ধরনের পাহাড় ও টিলা কাটা নিষিদ্ধ। তবে জাতীয় স্বার্থে কোনো পাহাড় বা টিলা কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের চার জেলায় এক সময় ১ হাজার ৮৭৫টি টিলা ছিল, যার আয়তন ৪ হাজার ৮১১ একর। গত দুই যুগে এসব টিলার প্রায় ৩০ শতাংশ কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ‘সেইভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের’ সিইও আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ‘টিলা কাটায় জড়িত একটি বিরাট সিন্ডিকেট। ভুমি কার্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে তারা মাঠে নামে।’ প্রশাসন আরও শক্ত পদক্ষেপ না নিলে সিলেটের টিলা হারিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর ও পরিবেশ কৌশল বিভাগের প্রফেসর ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, ‘পাহাড়-টিলা হলো পানির সংরক্ষণাগার। বৃষ্টির পানি পাহাড় ধারণ করে রাখে এবং বৃষ্টি না থাকলে ওই পানি পরিবেশের কাজে লাগে। পাহাড়-টিলা কাটলে এই ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ঝুঁকিতে পড়বে পরিবেশের ভারসাম্য।’ টিলা কাটা বন্ধে লোকজন মাঠে রয়েছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন। তিনি বলেন, ‘২০২১ সাল থেকে চলতি বছরের ৩ মার্চ পর্যন্ত ৮১টি অভিযান চালিয়ে ২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত ২১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদÐ দিয়েছেন।’ তার পরও টিলা কাটা বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল না থাকায় টিলা কাটা ঠেকানো যাচ্ছে না।
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃআব্দুল মুনিব মামুন, মোবাইল: 01715496849 অফিস: 406.Rangmohol Tower (4Floor) Bondor Bazar,Sylhet-3100। Email : banglasangbad1@gmail.com